আমরা যারা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই,আমাদের মনে হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হয়ত ইউরোপ,আমেরিকা বা পশ্চিমাবিশ্ব।কিন্তু না,বিশ্বের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একজন মুসলিম মহীয়সী নারীর হাতে।
আজকের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামব্রিজ বা স্ট্যানফোর্ড এরও প্রায় ২০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মরক্কোর কারাওয়ইন বিশ্ববিদ্যালয়,যার শিক্ষা কার্যক্রম আজ পর্যন্ত চালু আছে। ইউনেস্কো ও গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় মরক্কোর কারাওয়ইন বিশ্ববিদ্যালয়।প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এইখান থেকে শিক্ষা লাভ করে যাচ্ছেন।
৮৫৯ সালে মরক্কোর ফেজ এ বিশ্বের প্রাচীনতম এই বিশ্ববিদ্যালয়টি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।ফাতিমা আল ফেহরির পুরো নাম ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল ফেহরিয়্যাহ আল কোরাইশিয়্যাহ। জন্মগ্রহণ করেন ৮০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে, বর্তমান তিউনিসিয়ার কারাওয়ইন শহরে।ধারণা করা হয় তারা ছিলেন আরবের কুরাইশের উত্তরাধিকারী।তার পিতা পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারণে মরক্কোর ফেজ শহরে চলে আসেন।পরবর্তীতে তিনি নামকরা বণিক হয়ে উঠেন।তিনি তাঁর সন্তানদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেন।তারা দুই বোন ছিলেন।ফাতিমা এবং মারিয়াম।পিতার ইন্তেকালের পর ব্যবসায়ী পিতার রেখে যাওয়া সম্পদের মালিক হন দুই বোন।তখনকার ফেজ শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদে মুসলিমদের নামাজের সংকুলান না হওয়ায় ,ফাতিমা সিদ্ধান্ত নেন তিনি মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করবেন।তারা তাদের কাছাকাছি এলাকাতে দুইটি আলাদা মসজিদ নির্মাণ করেন।মরিয়মের প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি "মসজিদে আন্দালুস" নামে আর ফাতিমার মসজিদটি তাদের জন্মভূমির নামে "মসজিদে কারাওয়ইন" নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
এই মসজিদের পাশেই তিনি একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন।পরবর্তীকালে এটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তৈরি করা হয়।অতি শীঘ্রই এটি আফ্রিকার ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সমাদৃত হয়।এই বিশ্ববিদ্যালয় কুরআন ও ফিকহ (ইসলামিক আইনশাসন) এর পাশাপাশি ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, যুক্তি,জ্যোতির্বিদ্যা,গণিত,চিকিৎসাবিজ্ঞান,ভূগোল , রসায়ন, ইতিহাস সহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান ও গবেষণাগার হিসেবে গড়ে ওঠে এবং ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
এই বিশ্ববিদ্যালয় ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হত।এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু মুসলিমরা নয়,অনেক ইহুদি এবং খ্রীষ্টানরাও শিক্ষা লাভ করেন।এর ব্যাপক সুনাম গার্বার্ট অব অভার্গনেকে এখানে শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করে। অভার্গনে পরবর্তীতে পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার হন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষালব্ধ জ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।বাকি ইউরোপে আরবি সংখ্যা পদ্ধতি ও শূণ্যের ধারণার প্রচলন ঘটনার জন্য তাকে কৃতিত্ব দেয়া হয়।
কারাওয়ইন মাদ্রাসা এমন অনেক আলেমকে তৈরি করেছে যারা মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছে।এর মধ্যে ইবনে রুশায়দ আল সাবতী,মোহাম্মদ ইবনে আল-হাজ্জ আল-আবদারি আল-ফাসি, আবু ইমরান আল-ফাসি (যিনি মালিকি মাযহাবের একজন শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক ছিলেন) ইসলামী আইনশাস্ত্র;প্রখ্যাত ভ্রমণকারী ও লেখক লিও আফ্রিকানাস । আল-ইদ্রিসি , ইবনে আল-আরবি, ইবনে খালদুন , ইবনে আল-খতিব, আল-বিত্রুজি (আল্পেটেরগিয়াস), ইবনে হিরজিহিম এবং প্রমুখ অগ্রণী পণ্ডিতগণ সকলেই ছাত্র বা শিক্ষক হিসাবে মাদ্রাসার সাথে যুক্ত ছিল।
জানা যায় যে ,ফাতিমা আল ফেহরিও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।একসময় ১৯২২ -১৯৫৬ সালে মরক্কো ফ্রান্সের দখলে চলে যায়।ওইসময় সেখানকার শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।তখন লাইব্রেরীতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়।বিপুল সংখ্যক পান্ডুলিপি পুড়ে যাওয়ার পরেও সেখানে প্রায় ৪০০০ প্রাচীন পান্ডুলিপি রয়েছে।গ্রন্থাগারে বর্তমানে সবচেয়ে মূল্যবান প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে রয়েছে গজেল চর্চায় লিখিত মালিক ইবনে আনাসের বিখ্যাত আল-মুওয়াত্তা, সীরাত ইবনে ইসহাক, ১৬০২ সালে সুলতান আহমদ আল-মনসুর দ্বারা প্রদত্ত কুরআনের অনুলিপি এবং মূল গ্রন্থ ইবনে খালদুনের বই আল-ইবারের অনুলিপি।এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটিও বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরি হিসেবে প্রসিদ্ধ।
এ বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যযুগের মুসলমান ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞান বিনিময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এই মহিয়সী নারী ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত কারাওইন মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরি আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে এবং আলোকিত করে যাচ্ছে সারা বিশ্বকে।
ফাতেমা আল ফেহরির মত শত শত মুসলিম রমণীর অবদান রয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তাদের অবদান অনস্বীকার্য।ইতিহাস না জানার কারণে এই মহিয়সী নারীদের অবদান অজানাই রয়ে গেছে। ইতিহাসকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে আমরা খুঁজে পাবো শিকড়ের সন্ধান।যা আমাদেরকে আলোর পথ দেখাবে এবং বিশ্বকে আলোকিত করতে সহায়তা করবে ।